রম্য রচনা : সাংসারিক ক্রিকেট






ক্রিকেট কি শুধু শচীন - সৌরভ খেলে ? আমরা খেলি না! তাহলে ক্রিকেট নিয়ে এত মাতামাতি কেন ? অফিসে হাজিরা কম।কাজে মন কম।স্কুল এ ছাত্র কম। বাজারে সব্জি কম।বাসে ভিড় কম।রাস্তার লোক কম।প্ল্যাটফর্মে চেকার কম।ট্রেনে হকার কম।রকে রকে আড্ডা কম। মা -  বাবার বকুনি কম। সেলুনে লাইন কম।চোখে ঘুম কম।নিঃশ্বাসে বিশ্বাস কম।টিমের ওপর আস্থা কম।বেশি শুধু টিভির সামনে ভিড়।এ নিয়ে কাউকে কিছু বলি না,কেন না বললেই সম্পর্কে ধরবে চিড়। আরে না না ,আপনার সাথে আমার সম্পর্কটা তো একটু ইয়ের মতো মানে একটু বেশ মাখো মাখো তাই বলছিলাম আর কি ?



আচ্ছা আপনিই বলুন আমরা কি ক্রিকেট খেলি না ? শচীন - সৌরভ - রাহুল - কুম্বলের ক্রিকেটের চেয়ে আমাদের ' সাংসারিক ক্রিকেট ' কম কিসে? ফারাক শুধু ওরা ' ব্যাট'নিয়ে লড়ে আর আমরা ',ব্যাগ' নিয়ে লড়ি।ওদের ক্রিকেটের থেকে আমাদের ক্রিকেটের হয়তো কিছু কিছু ফারাক আছে।তাই বলে নামের ফারাক এত হবে কেন ?ওরা হলেন ' ক্রিকেটার'আর আমরা হলাম ' ছাপোষা '। আর 'ছা' পোষে না কে শুনি। আর ' ছা' পুষি বলেই তো আজ তেত্রিশ কোটি কে একশো পার করে দিলাম।ওরা একশো পার করলে তো হৈ হৈ করে সকলে নেচে ওঠে।পাড়ায় পাড়ায় বক্স বাজিয়ে ছেলে ছোকরাদের বাজি - রোশনাই সহযোগে উদ্দাম নৃত্য মহাদেবের প্রলয় নৃত্যকেও হার মানিয়ে দেয়।আর আমরা একশো পার করে দিলে সকলে গালে হাত দিয়ে হায় হায় করে  
কেন ?


এই যে দেশে - বিদেশে নানা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছে তার মূল রহস্য কিন্তু স্পন্সরশিপ।আর আমাদের ' বিবাহ' টুর্নামেন্টের স্পন্সরশিপ নেই একথা কি জোর গলায় আমরা বলতে পারবো ?কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা স্পনসর করে না ! কত রকমের প্রাইজ।আলমারী প্রাইজ,।সোনার গহনা প্রাইজ।দু- চাকা বা চার চাকা প্রাইজ।ফ্রিজ প্রাইজ।ক্যাশ প্রাইজ।ডিভান - খাট প্রাইজ। সামর্থ অনুযায়ী নানা রকমের প্রাইজ।আর সবশেষে সারপ্রাইজ।আর সারপ্রাইজটি হল স্পনসরার তার মেয়ের সারাজীবনের জন্য একজন লাইফ পার্টনারশিপ ( ভুলেও যেন শিপ অর্থে ভেড়া ভাববেন না।যদিও গ্রামে - গঞ্জে অবিডিয়েন্ট স্বামীকে মাগের ভেড়া বলার প্রচলন আড়ালে আবডালে শুনেছি) জোগাড় করে নেন।দেখা যায় হাজারে ৯৯৯ জনই আর পার্টনারশিপ ভাঙতে পারে না। কেন না রীতিমতো নিমন্ত্রণ পত্র সহযোগে সাপোর্টারদের আনিয়ে দুই আম্পায়ার বামুন ও নাপিতের উপস্থিতিতে অগ্নিদেবকে সাক্ষী রেখে উলু- শঙ্খ-বক্স-বাজনা- দাঁতভাঙা সংস্কৃত শ্লোক সহ এবং উভয় পক্ষের সাপোর্টারদের মধ্যপ্রদেশ যথাসাধ্য স্ফীত করার জন্য ভুরিভোজনের ব্যবস্থার মাধ্যমেই বাঁকাচোখে স্পন্সরারের প্রচ্ছন্ন একটা হুমকি তো থাকেই --- এটাই প্রথম ট্রফি এটাই শেষ ট্রফি। সারাজীবন অনুশীলন করে যেও কিন্তু নতুন কোন ট্রফির ধান্দা যেন কোরো না। আপাতদৃষ্টিতে পার্টনার হলেও  পরবর্তী দু বছরে প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে।আর তখনই শুরু হয় আসল ' সাংসারিক ক্রিকেট '।স্পনসর বিতর্ক ' সাংসারিক ক্রিকেটে' ও আছে।কি পেলাম ? কি পেতে পারতাম !সমযোগ্যতা নিয়ে কে কি পেয়েছে ? ----- ইত্যাদি ইত্যাদি।এখানে হয়তো ডালমিয়া সাহেব থাকেন না।,কিন্তু কোন না কোন মিঞাকে তো সামলাতে হয়।তবেই না বিতর্কের অবসান হয়।



আসলে 'বিবাহ' নামের টুর্নামেন্টের জয়লাভের পরে প্রভিশনাল ছাপোষা ডিগ্রি পেলেও পুরোপুরি ছাপোষা  হতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বছর দুই সময় লেগে যায়। ইতিমধ্যে কোল আলো করে নতুন অতিথির আগমন ঘটে।আর নতুন অতিথির বার্থ সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার সাথে সাথেই' সমাজ বিশ্ব বিদ্যালয়' তার সর্বোচ্চ উপাধি  ' ছাপোষা'তে ভূষিত করে।আর  তারপরেই শুরু হয় পুরোদমে তারস্বরে ' সাংসারিক ক্রিকেট '।নিউটনের গতিসূত্রের কথা আপনি নিশ্চয়ই জানেন ।কিন্তু এই অধমের  মতে আমাদের সাংসারিক জীবনে তিনটি ' অগতি' সূত্র আছে। এগুলো অগতির গতি কিনা তা অবশ্য জোর দিয়ে বলতে পারবো না।
অগতির সূত্রাবলি : 
প্রথম সূত্র : বিবাহ পরবর্তী প্রথম বছরে স্বামী বলবে এবং স্ত্রী শুনবে।
দ্বিতীয় সূত্র : বিবাহ পরবর্তী দ্বিতীয় বছরে স্ত্রী বলবে এবং স্বামী শুনবে।
তৃতীয় সূত্র : বিবাহ পরবর্তী তৃতীয় বছর থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দুজনেই বলবে কেউ শুনবে না,শুনবে পাড়া- প্রতিবেশী।


সাংসারিক ক্রিকেটে  দুই প্রতিপক্ষ  হল পতিপক্ষ ও পত্নীপক্ষ।একই পাড়ায় বা একই এলাকায় দীর্ঘদিন বসবাসের সৌভাগ্য দু - পক্ষেরই কিছু কিছু ফ্যান বা আল্ট্রা সাপোর্টার জুটে যায়,যাদের উস্কানিতে সাংসারিক ক্রিকেট আরো জমে ওঠে।সাংসারিক ক্রিকেটে যে যখন খুশি বোলিং, ব্যাটিং, ফিল্ডিং করে ----- ইনিংস ধরে হয় না।এখানে স্লগ ওভার বলে কিছু নেই। সুতরাং সুযোগ পেলেই সপাটে কভার করতে হয়।প্রতিদিন  সাংসারিক ক্রিকেটের ওয়ানডে ম্যাচ হয়।আর যতদিন বাঁচবো চলতেই থাকবে।


এই যে আজ সারাদিন আমার সংসারে যে কান্ড হল তা কি ওয়ান ডে ক্রিকেট নয় ?এখন রাত এগারোটা ।আমার পুত্র জগন্নাথ ঘুমের দেশে।আমার স্ত্রী  অপরাজিতার মশারি টাঙানোর পালা শেষ।বাইরে হিমেল হাওয়া  বইলেও আমার ঘরে দরজা জানালা বন্ধ থাকায় তার প্রবেশ নিষেধ।আমার ঘরে এখন ঘুমেল হাওয়া।দু জনেরই ঢুলু ঢুলু চোখ।ঝিমুনির আবেশ।সারাদিনের সাংসারিক ক্রিকেটে আমরা ক্লান্ত - পরিশ্রান্ত।শুতে যাওয়ার আগে খাটের মড় মড় শব্দ জানান দেয় আমরা কেউ হারিনি, আমরা কেউ জিতিনি, আমরা যুগ্মবিজয়ী হয়েছি।



অথচ সকাল শুরু হয়েছিল অন্যভাবে।আমি আধ জাগা আধ ঘুমো অবস্থায় মনে মনে ভাবছি  কতদিন ভোরের আকাশে সূর্যদেবের লাজুক উঁকিমারা দেখিনি।সাধ হয়, সাধ্য হয় না। পরমুহূর্তেই ধরা পড়ি লেপের মায়াবী বন্ধনে।ঘুমে যে এত সুখ তা আমার মতো ঘুমকাতুরেই  বোঝে।এমন সময় রান্নাঘরের দিক থেকে আমার স্ত্রী অপরাজিতা সুমিষ্ট গলায় একটি ফুলটস বল করল ' কি  গো অনেক বেলা হল,এবারে ওঠো '।  আমি কোন পাত্তাই দিলাম না। মনে মনে যা বললাম তা গিন্নীর কানের বহুদূর দিয়ে বাউন্ডারি লাইনের বাইরে অর্থাৎ চার।প্রায় মিনিট পাঁচেক বাদে পাশের ঘর থেকে গিন্নির একটি শর্টপিচ ডেলিভারী এল ' কি আর কতক্ষণ? আজ ছুটির দিন নয় কিন্তু! বিছানায় পড়ে থাকলে চলবে ?'  আমি কোন পাত্তা না দিয়ে পাশ  ফিরে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আমার দৌড় তো পরের বল পর্যন্ত।পরের বল অবধারিত গুগলী।আর আমি বাধ্য ছেলের মতো দু - হাত তুলে ৩২ পাটি বের করে লেপের ভিতর থেকে হাই তুলতে তুলতে বেরিয়ে এলাম। না এলে কি হতে পারতো তা আমি  ভগবান আর আমার বাড়ীর কাজের মেয়ে মিঠু বাউরি জানে। আমার ব্যাটিং শেষ।এরপর সারাদিন ফিল্ডিং।মাঝে মাঝে খোঁচা মেরে  সুযোগ মত দু'চারটে কথা শুনাতে পারলেই মনে মনে বোলার সেজে উইকেট নেওয়ার আনন্দে আত্মহারা হই।



সকালেই ফিল্ডিং করতে করতে ব্যাগ হাতে বাজার চলে যাই।আলুটা, মুলোটা, কলাটা, কফিটা, মাছটা, মাছের তেলটা পারলে আঁশটাও ভরে নিয়ে আসি বাজারের ব্যাগে।তারপর চলে যাই ফিল্ডিং করতে করতে মুদির দোকানে চাল ---- নুন ---- আটা।
ফিল্ডিং মানে দর কষাকষিতে মাথাব্যাথা হবার উপক্রম। তারপর কোনরকমে স্নান করে দু' মুঠো গিলে ব্যাগ হাতে অফিস।আসার পথে অপরাজিতার বলতে ভুলে যাওয়া জিনিসগুলো নিয়ে আসি।ফিরে এসে ফিল্ডিং করতে করতে এটা-সেটা ফাইফরমাস  খেটে ডানহাতের কাজ সারতে সারতেই খেলা শেষ।বিছানা রেডি।


শুনলে অবাক হবেন আন্তজার্তিক ক্রিকেটের মতো আমাদের সাংসারিক ক্রিকেটের ইউনিট কিন্তু একই।এই ধরুন শচীন পায় এত কোটি,সৌরভ পায় এত কোটি----- ইত্যাদি ইত্যাদি।আর আমাদের সাংসারিক ক্রিকেটে চাল এত কোটি------ ডাল এত কোটি------ মুড়ি এত কোটি। আবার শচীন - সৌরভদের মতো আমরাও অভিনন্দন পাই।তবে মাঝ রাতে ই আমরা অভিনন্দন পাই না।মাঝরাতে আমরা আবেগে ভাসি।অভিনন্দন পাই আরো দশমাস দশদিন বাদে।


-------------------------
রচনা : ডঃ গৌতম কুমার মল্লিক
বি: দ্রঃ
আমার লেখা এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩ সালে 'আজকের পল্লীকথা য় (২য় বর্ষ,৩য় সংখ্যা, মার্চ ২০০৩)














Comments

  1. দারুন হয়েছে।

    ReplyDelete
  2. Excellent Excellent ❤️
    দূর্দান্ত রচনা।
    মন ছুঁয়ে গেলো
    অপূর্ব সুন্দর প্রকাশ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

রম্য রচনা :এক ব্যস্ত মানুষের সাক্ষাৎকার

রম্য রচনা : এক আস্ত ভূতের সাক্ষাৎকার

রম্য রচনা : বিজ্ঞাপনের পাতা