রম্য রচনা : দূর্গা যাবেন বাপের বাড়ি
মর্ত্যের বাতাসে এখন আনন্দফোয়ারা।নীল আকাশে হাসিমুখে ঘোরাফেরা করছে পেঁজাতুলা মেঘ।রোজ ভোরে সূর্যদেবের লাজুক উঁকিমারা দেখে ভরে যাচ্ছে মানুষের মন।আনন্দে গদগদ হয়ে সূর্যদেব সোনাগলা রোদ্দুর ছড়িয়ে দিচ্ছে সবুজ গাছের প্রতিটি পাতায়।মাঠে মাঠে কাশফুলের হাসি ও শিউলি ফুলের গন্ধ মনে করিয়ে দেয় মা দূর্গার আগমন বার্তা।ঘাসের আগার মুক্তো শিশির মনে করিয়ে দেয় গ্রামে ফেরার কথা।আর তাই পথে পথে মানুষের ঘরে ফেরার ঢল।বাড়ীঘর সব সেজেগুজে ঝকঝকে তকতকে।দোকানে দোকানে রং বেরং এর পোশাকের মেলা।আনন্দে মাতোয়ারা মর্ত্য।
অন্যদিকে কৈলাসে বিষাদের সুর। মা দূর্গা বাপের বাড়ি গেলে শ্মশানে মশানে থাকা ভোলেভালা ভোলা মহেশ্বরের কি হাল হকিকত হবে সে কথা ভেবে ভেবেই সকলের গালে হাত।এদিকে দেবীদুর্গার মর্ত্যে যাবার দিন যত এগিয়ে আসছে মহাদেবও তত মনমরা হয়ে যাচ্ছেন।হাসির মোড়কে যতই ঢাকার চেষ্টা করুন না কেন বডি ল্যাঙ্গুয়েজ কিন্তু অন্যকথা বলছে।কিন্তু কি আর করা যাবে।বাপের বাড়ী বলে কথা ।তাও আবার মাত্র তিনদিনের জন্য।সে তো ছাড়তেই হবে ।তবে দূর্গাকে নিয়ে মহাদেবের গর্বও কম নয়। কেননা মহাদেব ভাল করেই জানেন আজকের দিনের মর্ত্যের আল্ট্রামডার্ন বৌয়েরা যেখানে শ্বশুর বাড়ী- ই যেতে চায় না সেখানে দূর্গা দেবী হয়েও মাত্ৰ তিনদিনের জন্য - গর্ব হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
মহাদেবের দিনকয়েক গাঁজা টানার যে রেট বেড়েছে তাতে নন্দী ও ভৃঙ্গিও চিন্তিত।রক্তবর্ণ চোখে বিরস বদনে গঞ্জিকা সেবন রত মহাদেব উদাস মনে বসে হতাশার নানা হাতছানির কথা ভাবছেন এমন সময় দেবী দূর্গা এসে হাজির । বললেন " ওগো শুনছো ?"
মহাদেব বললেন 'কে ? কে? কি ব্যাপার '!
নন্দী ভৃঙ্গি সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সমস্বরে বলে উঠলো " প্রভু মাতা ঠাকরুন এসেছেন । '
মহাদেবের তো ভয়ে সিটকে যাওয়া অবস্থা।একে গঞ্জিকা সেবন নিষেধ।তার উপর তো আর কি বলবো বিশ্বশুদ্ধ কর্তারা এমনিতেই গিন্নিদের ভয়ে তটস্থ।মহাদেবই বা আবার ব্যতিক্রম হবেন কেন ? কিন্তু মা দূর্গা মহাদেবের কানে কানে যা আর্জি জানালেন তা মানা সম্ভব নয়।মহাদেব বললেন ---- ' না না দূর্গে তা হয় না।মর্ত্য জুড়ে মানুষ কত প্যান্ডেল করেছে। মাইক বক্সের অর্ডার দিয়েছে।মহালয়া হয়ে গেল।দুদিন বাদে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে হাজার হাজার আলো ঝকমক করে উঠবে।তাছাড়াও লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক গণেশ মামাবাড়ি যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে আছে।একথা শুনলে ওরাও মুষড়ে পড়বে।
দূর্গা বললেন - ' কোন রাগ অনুরাগ নয়,সত্যিই জানিনা এবারে মন যেন যেতে চাইছে না।বাপের বাড়িতে গিয়ে যদি দু - দিন শান্তিতে না থাকা যায় তবে কার ভালো লাগে বল।চারিদিকে শুধু অশান্তি আর অশান্তি --- গুলি - বোমা -বিস্ফোরণ - পেটো - টাঙ্গি -বল্লম-ছুরি -রক্ত-মৃত্যু এসব কারও ভালো লাগে ।'
মহাদেব বললেন --- ' তুমি কোন চিন্তা করো না ।আমি নারদমুনিকে মর্ত্যে পাঠিয়েছিলাম।খবর যা এসেছে তাতে তুমি অনায়াসে এখনও মর্ত্যে যেতে পারো। নারদমুনি যা দুর্দান্ত দুর্দান্ত প্যান্ডেলের খবর এনেছেন শুনলে চমকে যাবে দুর্গে।'
দূর্গা বললেন -'ঐটিই হয়েছে কাল।মানুষের মন এখন প্যান্ডেলে।আগেকার মত অন্তরের পূজা আর নেই।সবকিছু লোকদেখানি।আমি অনেক মানুষ দেখেছি পূজা মণ্ডপে এসে আমাকে না দেখেই প্যান্ডেল দেখে বাড়ি চলে যায়।মানুষের হৃদয় থেকে শ্রদ্ধাভক্তি কর্পূরের মত উবে গেছে।মানুষ এখন আড়ম্বরের পূজারী।
মহাদেব বললেন - ' তাতে ক্ষতি কি ?'
দুর্গা বললেন - ' তুমি কি বুঝবে ,শুনি ? তোমাকে যেয়ে তো তিনদিন ধরে প্যান্ডেলের ভিতর দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না।তুমি জান কত বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়ে ছেঁড়া জামাপ্যান্ট পরে আমায় দেখতে আসে।তারা মুখে কিছু বলে না।তাদের চোখেমুখে অভাবের ছবি দেখি।আমার হৃদয় কেঁদে ওঠে।আমি যে মা ,কিসের মা ? যুগ যুগ ধরে বছরে একবার করে এসে ওদের আশীর্বাদ করে যাচ্ছি তবে কি আমার আশীর্বাদে কোন কাজ হচ্ছে না।তাহলে হাজার হাজার আলো আর হাজার হাজার টাকার প্যান্ডেলের দরকার কি ?
মহাদেব বললেন --' দরকার আছে প্রিয়ে ,দরকার আছে।আড়ম্বর আছে বলেই লাইটওয়ালা, ডেকোরেটার্সর মালিকরা পয়সা পায়।পয়সা পায় বলেই তারা ঐ ব্যবসাগুলি চালায়।ঐ ব্যবসাগুলি চলে বলেই ওরা কিছু লোক রাখে।এর মাধ্যমেও তো কিছু লোকের পেটের ব্যবস্থা হয়।ওসব কথা ছাড়।এখন শোন নারদমুনি খবর এনেছেন এবারে হরেক রকমের প্যান্ডেল হচ্ছে, ধূধুলের ,দড়ির, নারকেল ছোবড়া, রুদ্রাক্ষের তবে সবচেয়ে অভিনব হচ্ছে বিড়ির প্যান্ডেল।
নন্দী ভৃঙ্গি এতক্ষণ শুনেই যাচ্ছিল, এবারে সমস্বরে বললো --' বিড়িতে গাঁজা ভরা নেই তো ?
মহাদেব বললেন --- ' ভেবে দেখেছিস ৫০ লাখ বিড়ি ( গাঁজা ভর্তি) একসাথে জ্বললে কি হবে ? বিড়ির ধোঁয়া নৃত্যরত লাস্যময়ী যুবতীর মত কুন্ডলী পাকিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে যখন কৈলাসের পথে আসবে তখন সারা কৈলাস-'----- মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দূর্গা বললেন ' যে যার নিজের তালে আছো।আমার অবস্থা কি হবে ভেবে দেখেছো। নিকোটিনের গন্ধে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে।না না আমি ঐ সকল প্যান্ডেলে যাবো না।যদি যাই আমি ,যাবো যারা গরীব মানুষদের বস্ত্র বিতরণ করবে,যারা রক্তদান শিবির করবে, যারা খরচ বাঁচিয়ে গরীব মানুষদের খাওয়াবে, যারা শান্তির বাণী প্রচার করবে, যারা সম্প্রীতি কথা বলবে সেই সমস্ত প্যান্ডেলে।
মহাদেব বললেন ---- তাই যেয়ো।তোমার আর কিছু বলার আছে ?
দূর্গা বললেন ---- আছে।আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করছি, দিন দিন পূজার আড়ম্বর বাড়লেও পূজারীর দক্ষিনা কিন্তু তেমন বাড়ে নি।কেন বলতে পারো ?
মহাদেব বললেন ------ এটা মানুষের স্বভাব দোষ।এর জন্য দুঃখ পেতে নেই।আর বেশি দেরী কোরো না।ওদের সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়।ঐ তো আগমনী গান শোনা যাচ্ছে।
-------------------------
রচনা : ডঃ গৌতম কুমার মল্লিক
বি: দ্রঃ
আমার এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০০২ সালের ১৭ই অক্টোবর বাঁকুড়া থেকে প্রকাশিত পুষ্পাঞ্জলি সাময়িকী তে।
K খুব ভালো হয়েছে।
ReplyDeleteThank you।
Delete