রম্য রচনা : বুড়ো দাঁতালের প্রেমের উচ্ছ্বাস




অতি সম্প্রতি মেদিনীপুর জেলার চাঁদড়া বিট এলাকার ঘটিয়া যাওয়া  ঘটনাটিকে লইয়া তোমরা যেভাবে হৈচৈ আরম্ভ করিয়াছ, আমি তাহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি।এমনকি শুনিতেছি তোমরা নাকি পেপারের প্রথম পাতাতেই আমার ছবিও বাহির করিয়া দিয়েছো।তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কি আমরা কখনও নাক গলাইয়া থাকি ? তাহা হইলে আমাদের ' হস্তিগত' ব্যাপারে তোমরা নাক গলাইবে কেন ? দীর্ঘদিন ধরিয়া দেখিতেছি যে আমরা ভাটমারা, খরিকাশুলি, নোহারি,গিলাবনী, পিয়ারডোবা, ধাদিকা, শ্যামনগর, গড়বেতা,রসকুন্ডু, পানিকোটর, বীরঘসা, খড়কুশমা, আরাবাড়ি ও জয়পুরের জঙ্গল সহ যে এলাকাতে বিচরণ করিয়া থাকি তা তোমাদের পছন্দ নয়।একবার আমরা কলকাতার রাস্তা ধরে প্রাতঃ ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম, তখন তোমাদের বাংলা দৈনিক গুলি কত কীই না লিখিয়াছিল।আমরা তাহাও সহ্য করিয়াছি।অথচ দেখ আমরা বিগ্রেড অভিমুখেও যাই নাই,আবার রাইটার্স  অভিমুখেও যাই নাই। আমাদের কোন দাবী নেই।তাহা বলিয়া আমাদের কোন অধিকার থাকিবে না কেন ?এই পৃথিবীর আলো বাতাস মাটিতে আমাদেরও সমান অধিকার আছে। বিবর্তনের ইতিহাসের গতিপথের যদি চুলচেরা  বিশ্লেষণ করা হয় তবে কি এইকথা দাঁড়াইবে না যে ,আমরা উভয়েই আসিয়াছি পৃথিবীর সেই আদিমতম এক কোষী জীব হইতে।তৎসত্ত্বেও তোমরা পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ সমস্ত কিছুই উপভোগ করিতেছো আর আমরা শুধু পাতা চিবাইতেছি তাহাও তোমাদের সহ্য হইতেছে না।

উড়িষ্যার সুপার সাইক্লোনের পর যখন নিরুপায় ক্ষুধার্ত হাতিরা দল বাঁধিয়া খাবারের সন্ধানে ভুবনেশ্বর শহরে  ঢুকিয়া পড়িয়াছিল তখন তোমরা লিখিয়াছিলে ' বুভুক্ষু লুটেরা মানুষের থেকেও তারা বিপদজনক '। আমরা নীরবে তাহাও সহ্য করিয়াছিলাম।আমাদেরকে ফাঁদে ফেলিবার জন্য তোমাদের নিয়োগ করা ' কুনকি' যখন ' দাঁতালের' প্রেমে আত্মহারা  হয়ে দুই চোখ অশ্রু ধারায় ভাসাইয়া দেয়,তখন তোমরা গেল গেল রব তুলিয়া থাকো।তাহাও আমাদের সহ্য করিতে হইয়াছে।
কিন্তু আর নয়।আমাদের পৃষ্ঠদেশ গাছের গুঁড়িতে ঠেকিয়াছে।এখন রুখিয়ে দাঁড়ানোর সময়।
হ্যাঁ আমি স্বীকার করিতেছি আমি এক তরুণী হস্তিনীর প্রেমে পড়িয়াছি।প্রেম কি অপরাধ ? তাহা হইলে এত হৈ চৈ কেন ? আর কোন আক্কেলেই বা তোমরা ইহাকে ' বেমক্কা প্রেম' ,বলিতেছ।আরে যদি' বেমক্কা প্রেম' হয়েই থাকে তাহা কি তোমাদের সমাজে নেই।চারিপাশ টা একটু ভাল করিয়া তাকাইয়া দেখ।দেখিবে প্রেমের কোন  বয়স নেই। আর তাই যদি থাকতো তাহা হইলে তোমাদের সমাজে  ' বৃদ্ধশ্য তরুণী ভার্যা ' কথাটি প্রচলিত থাকিতো না। চোখের সামনে আগুন জ্বলিতে থাকিলে  কি ঘি না গলিয়া থাকিতে পারে? আমারও হইয়াছে  সেই দশা। তোমরা কি ভুলিয়া গিয়াছো Sir W Temple এর সেই কথা ' The greatest pleasure of life is love'. নাকি আজকাল তোমাদের মন বলিয়া আর কিছু নাই। তোমাদের মনের ক্ষুধা বলিয়া কিছু নাই। যদি থাকতো তাহা হইলে তোমরা  Franklin এর কথা ' One should eat to live, not live to eat' ভুলিয়া যাইতে না। হয়তো বলিতে পারো তোমাদের মনের ক্ষুধা  মিটাইবার অনেক রাস্তা রহিয়াছে।টিভি আছে, রেডিও আছে, সংবাদপত্র আছে, বার আছে, ক্লাব আছে কিন্তু আমাদের তো কিছু নেই।আমাদের আছে শুধু প্রেম।


আসলে তোমাদের বোধহয় বিষয়টি ঠিক বুঝাইতে পারিতেছি না।একটা উদাহরণ দিলে বোধহয় বিষয়টি বুঝিতে তোমাদের সুবিধা হইবে।আমি বলছিলাম প্রেম জিনিসটা খানিকটা চুম্বকের মতন।বিপরীত মেরুর আকর্ষণ কিছু বুঝিলে ?ইহার বেশী বলিবার সাধ্য বা সামর্থ কোনটাই  আমার নেই।তবে একথা ঠিক তোমাদের সমাজ - ই বল আর আমাদের সমাজ - ই বল ' প্রেম' কে কোনোদিন -ই মানিয়া লইল না।সুতরাং সমাজের চোখে প্রেম সবদিন - ই অবৈধ।ইহা তো গেল 'ব্যক্তিগত ' ও ' হস্তীগত' প্রেমের কথা।এমনকি
মহাপুরুষেরাও  ' মানবতাবাদের' কথা প্রচার করিতে যাইয়া বাধা প্রাপ্ত হইয়াছেন।আর আমরা হইলাম তো শুধুমাত্র ' পুরুষ' এমন কি ' বীরপুরুষ' বা ' সুপুরুষের' দলেও পড়ি না।বড়জোর কাপুরুষ হইলেও হইতে পারি। রক্ত তো একটু ঝরিবেই।তাই বলিয়া কি নিজেকে neglect করিতে পারি ? ঐ যে বলে না' Self-love is not so vile a sin as self neglecting. কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সেও যখন মাইকে বাজতে থাকে ' বাতাসীরে প্রেমের খেলা কে বুঝিতে  পারে ------' তখনও যে আমি ফুরফুরে মেজাজে কুলার মত কর্ণযুগলকে মস্তক সহ হেলাইয়া থাকি ইহা কি যথেষ্ট নয়। হয়তো আজকে আমার রক্তাক্ত বিধ্বস্ত ক্লান্ত শরীরটাকে দেখিয়া মানুষ অনেক কথাই বলিতেছে।উপহাসও করিতেছে।ভালবাসা কি সত্যিই চোখে দেখা যায় ? যায় না।হৃদয় দিয়ে অনুভব করিতে হয়।ইহা আমার কথা নয়।Shakespeare বলিয়া গিয়েছেন ' Love looks not with the eyes, but with the mind'. বিশ্বাস করো যখনই আমি তরুণী হস্তিনীকে দেখি তখনই আমার হৃদয় আনচান করিয়া উঠে। সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়,সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে Keats এর সেই কথাগুলিই  বলিয়া থাকি 'Beauty is truth, truth beauty '. আমারই দোষ কি বল মহারাণী এলিজাবেথের একটি কথা বলি '  A good face is the  best letter of recommendation'.আর আমি হইলাম এক বিশালাকার প্রাণী।'Good face' এর প্রতি আমার ',Weakness' থাকিবে ইহাই তো স্বাভাবিক।


পরিশেষে বলি তোমাদের সহিত কি আমাদের খুব একটা পার্থক্য রহিয়াছে ? ইহাও আমাদের কথা নয়,তোমাদের Burke -র কথা-ই  বলিতেছি ' Man is an animal that cooks his victuals'.


---------------------
রচনা : ডঃ গৌতম কুমার মল্লিক

বি: দ্রঃ
আমার এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত সত্যপথ ও সদচারী পত্রিকায়২০১১ সালে।পরবর্তীতে আমার ' দম ফাটানো হাসির রম্য' বইটিতে স্থান পেয়েছে।




Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

রম্য রচনা :এক ব্যস্ত মানুষের সাক্ষাৎকার

রম্য রচনা : এক আস্ত ভূতের সাক্ষাৎকার

রম্য রচনা : বিজ্ঞাপনের পাতা