রম্য রচনা : কালুর দুঃখ
আমার সারা শরীরের স্থানে স্থানে দগদগে ঘা।রোদে একদম থাকতে পারি না।মুখের ভাষায় আমার যন্ত্রণার কথা আজও তোমাদের বোঝাতে পারলাম না।তোমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাই।তোমরা বোঝ না, নাকি না বোঝার ভান কর তাও আমি বুঝতে পারি না।এ যে কি যন্ত্রণা, যে ভোগ করে সেই বোঝে !
হটাৎ যে তোমাদের কি হল আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার উপর রাগ হয়েছে।তবে শাসন কর।কিংবা ক্ষমা পরম ধর্ম তা তো জানোই -- সেই সূত্রটার প্রপার এপ্লিকেশন কর।তাও তো কোরছো না।দোহাই তোমাদের, আমাকে পরপর ভেবো না। সারাটা জীবন তোমাদের সেবা করে এসেছি।সুখে দুঃখে সব সময় তোমাদের পাশে পাশেই থেকেছি।আজ আমার এই দুঃসময়ে তোমাদের কাছে এমন দুর্ব্যবহার পাব তা সত্যিই দুর্ভাগ্যের এবং দুঃখজনক।তোমাদের কোয়ার্টারের সিঁড়িগুলিতে এক সময়ে লেজ নাড়িয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছি, অথচ সেই তোমরাই অসুস্থ, রুগ্ন কালুকে দেখলে তেড়ে আসছো।তোমাদের ক্যাম্পাসের সদানন্দবাবু যিনি সদাই হাসিমুখে থাকেন, তিনিও আমাকে লাঠি দেখাচ্ছেন।অরুণবাবু চোখ রাঙিয়ে বিকট আওয়াজ করছেন।আমার দু চোখ জলে ভাসে।
তোমরা তা দেখতে পাও না।পৃথিবীতে আমার আর বেশিদিন নেই।পরপারে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে।যে কটাদিন বাঁচি, আছি তোমাদেরই কাছাকাছি।বিশ্বাস কর সিঁড়ির এককোনে চুপচাপ একটু ঠান্ডায় বসে সুখস্মৃতিগুলি একটু কড়াই গন্ডায় ঝালিয়ে নিই।
অভিভাবকহীন অবস্থায় ভবের মাঠে ঘুরতে ঘুরতে কবে যে তোমাদের দক্ষিণী ক্যাম্পাসে এসে জুটেছিলাম তা আজ আর সঠিক মনে নেই।ছোট থেকেই আমার গায়ের রঙ কালো, তবে দেখতে মোটেও খারাপ ছিলাম না।কালোর উপর সাদার বেশ কয়েকটি বিউটি স্পট মিলিয়ে বেশ দেখায়।তোমাদের ফেলে দেওয়া একটা ভাঙা আয়নায় একবার আমি নিজের মুখ দেখেছিলাম।অথচ কিছুদিন বাদে জানতে পারলাম তোমরা আমার নাম রেখেছো কালু। দুঃখ যে আমার একেবারে লাগেনি তা নয়।নানাভাবে সাদা বিউটি স্পটটি তোমাদের দেখানোর চেষ্টা করেছি।কোন লাভ হয় নি।আমার নাম কালুই রয়ে গেছে। আমার কোন পরিচয় পত্র নেই।অল্প দিনেই তোমাদের ক্যাম্পাসের সকলের সাথেই পরিচিতি হয়ে যাওয়ার সুবাদে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার চরমপত্রও কেউ আমাকে দেয় নি।দুবেলা দু মুঠোর অভাব তোমাদের দৌলতে কোনদিন - ই হয় নি। এমনকি বিকেলবেলায় বেড়াতে বেরিয়ে হর্ষ-রিকু-তিস্তা-বিদিশারা কিছু খেলে আমাকেও একটু দিত।আর খেতে খেতে আমি আনন্দে লেজ নাড়াতাম।কিংবা বিকেলবেলায় যখন গুড্ডু, নন্তে, বা বিট্টু রা ব্যাটবল নিয়ে খেলত তখন ওদের আনন্দের ভাগিদার হিসেবে আমি ঘাসের উপর গড়াগড়ি দিতাম।কোনো অচেনা লোকের উপস্থিতি ঘেউ - ঘেউ - ভূক শব্দে জানিয়ে দিতাম।তোমরা যেমন আমাকে আপন করে নিয়েছিলে,আমিও তোমাদের পর ভাবিনি।
দক্ষিণী ক্যাম্পাসকে কাঁদিয়ে যেদিন নন্দবাবু চিরবিদায় নিলেন সেদিন কি শুধু তোমরাই কেঁদেছিলে ? আমিও কেঁদেছিলাম।বিশ্বাস কর সারারাত কেঁদেছিলাম।কিংবা মিতা ও সোনার বিয়ের কথাই ধরা যাক না।আমাকে তো নিমন্ত্রণ পত্র দেওয়া হয় নি।কিন্তু আমি পর ভাবিনি।পেটপুরে খেয়েছিলাম।সঙ্গে আবার গার্ল ফ্রেন্ডকেও এনেছিলাম।'রাই' এর যেদিন জন্ম হল ক্যাম্পাসের সকলের পিছু পিছু আমিও নার্সিংহোমে গিয়েছিলাম। তোমাদের সুখ -দুঃখ - আনন্দের সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলাম নিজেকে।
এখন তোমাদের ক্যাম্পাসে সিকিউরিটি গার্ড বসেছে।কিন্তু একদিন ছিল রাত্রির পাহারাদার বলতে শুধু এই অধম কালু।তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না ! তোমাদের আদরের সেই কালু আজ বড় অসহায়।বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত। লোম ওঠা দেহ নিয়ে কোনক্রমে কষ্টেসিষ্টে কালাতিপাত করছে ? তোমাদের কি কোন কর্তব্য নেই? তোমাদের কালু কি তোমাদের কাছ থেকে একটুকুও সহানুভূতি আশা করতে পারে না ? ইতিমধ্যে তোমাদের ক্যাম্পাসে মানসবাবুর বাড়িতে ' স্যামি' এসেছে।'স্যামি' কে নিয়ে তোমাদের মাতামাতি আমার হৃদয়ে প্রতি মুহূর্তে কুঠারাঘাত করে।সকালে বিকালে যখন মানসবাবু ও রুপা 'স্যামি'কে নিয়ে বেড়াতে বের হয় ,তখন তোমাদের সকলের চারিদিক থেকে 'স্যামি','স্যামি' ডাক আমার সহ্য হয় না।একদিন তো সবাই ' কালু','কালু' করে আদর করে ডাকতে।আজ আর ডাকো না কেন ? তবে কি বিদেশী পেয়ে দেশীদের ভুলে গেলে? সবাই যদি বিদেশী পেয়ে দেশীদের ভুলে যাও আমাদের মত দেশী নেড়িকুত্তারা যাবে কোথায়?
--------------------
রচনা : ডঃ গৌতম কুমার মল্লিক
বি :দ্রঃ
আমার এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ভূমিপুত্র শারদ সংখ্যায় ,২০০৫ সালে।
খুব সুন্দর,
ReplyDeleteধন্যবাদ।ভালো থাকবেন।
Deleteবেশ ভালো।
ReplyDeleteThank you
Delete